‘ওরা আমার মুখের ভাষা
কাইড়া নিতে চায়
ওরা, কথায় কথায় শিকল পরায়
আমার হাতে পায়।’
বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নিতে মরিয়া পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর ঘৃণ্য চক্রান্তে গর্জে ওঠে হার না মানা বাঙালি। তীব্র প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে দুখিনী বর্ণমালা। আর মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষার দাবিতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত করে বাংলার দামাল সন্তানেরা।
জাতির দিনবদলের পালা শুরু হয়েছিল সেদিনই, ‘অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে সেদিন বর্ণমালা/ সেই থেকে শুরু…/ সেই থেকে শুরু দিনবদলের পালা।’ বাংলা ও বাঙালির মননে অনন্য মহিমায় ভাস্বর চিরস্মরণীয় সেই দিন আটই ফাল্গুন, গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা মতে একুশে ফেব্রুয়ারি।
ইতিহাসের পাতায় রক্ত পলাশ হয়ে ফোটা সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউর, সালাহউদ্দিন, আউয়াল, অহিউল্লাহর রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।
আজ সেই মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সারা বিশ্বের কোটি কণ্ঠে আজ উচ্চারিত হবে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা কালজয়ী গান,
‘রক্তে আমার আবার প্রলয় দোলা
ফাল্গুনে আজ চিত্ত আত্মভোলা
…একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি…।
গীতিকার ও সুরকার আবদুল লতিফের ‘আমি কেমন কইরা ভুলি/ মুখের কথা কইতে গিয়া/ ভাই আমার খাইছে গুলি।’ ভাষাশহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে আজ বুধবার সারাদেশ থাকবে শহীদ মিনার মুখী। হাতে শ্রদ্ধার ফুল, কালো ব্যাজ আর হৃদয়ের দৃপ্ত উচ্চারণ ‘সালাম সালাম হাজার সালাম/ সকল শহীদ স্মরণে/ আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই/ তাঁদের স্মৃতির চরণে।’
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে ঘটেছিল বাঙালির ইতিহাস পাল্টে দেয়ার ঘটনা। ‘বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা’ স্লোগানে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেয় বাঙালি।
ইতিহাসবিদদের মতে, ভাষার প্রশ্নে একুশের আন্দোলন হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে তা ছিল শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ। সেদিন আত্ম-অধিকার, সমতাভিত্তিক সমাজ আর অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রবিনির্মাণের স্বপ্নে জেগে উঠেছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ।
একুশের আন্দোলনেই ঘটে বাঙালির আত্মবিকাশ, যার ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে এসেছে অমৃত স্বাধীনতা।
একুশে তাই বাঙালির চেতনার প্রতীক। একুশে শহীদদের ঠাঁই এখন প্রতিটি বাঙালির মর্মমূলে। পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় উচ্চারিত হয় একেকটি নাম। মহান ভাষা শহীদদের স্মরণে সারাদেশে, অগণিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং বিদেশে যেখানে রয়েছে বাঙালি, সেখানেই গড়ে উঠেছে অহঙ্কারের প্রতীক শহীদ মিনার।
একুশে তাই আত্মত্যাগের অহঙ্কারে ভাস্বর মহান একটি দিন; জেগে ওঠার প্রেরণা। দেশমাতৃকার প্রয়োজনে আত্মোৎসর্গ করার শপথ গ্রহণের দিন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদদের স্মরণে ‘জাতীয় শহীদ দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বে পালিত হবে নানা আনুষ্ঠানিকতায়।
রাষ্ট্রীয় আয়োজনে একুশের অনুষ্ঠানমালার সূচনা হয় রাত ১২টা ১ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ সংলগ্ন একুশের রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে।
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা একুশের প্রথম প্রহরে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। এরপর সর্বস্তরের মানুষের জন্য খুলে দেয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার।
‘একুশ মানে মাথা নত না করা’ চিরকালের এ স্লোগান আর বুকে শোকের প্রতীক কালো ব্যাজ ধারণ করে, খালি পায়ে আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই শামিল হতে শুরু করেন শহীদ বেদীতে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। আজ সরকারি ছুটির দিন। অর্ধনমিত রাখা হবে জাতীয় পতাকা। একই সঙ্গে সর্বত্র ওড়ানো হবে শোকের কালো পতাকা।
সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও বেতারে ভাষা দিবসের বিশেষ ক্রোড়পত্র ও অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হচ্ছে। মাতৃভাষার মর্যাদা রাখতে গিয়ে বুকের রক্ত ঢেলে বাঙালি জাতি যে ইতিহাস রচনা করেছিল, শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্ব তাকে বরণ করেছে সুগভীর শ্রদ্ধায়।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর তাদের ৩০তম সম্মেলনে ২৮টি দেশের সমর্থনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে একযোগে এ দিবসটি পালিত হচ্ছে।
এ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বাঙালি জাতির জন্য এক অনন্যসাধারণ অর্জন। রক্তক্ষয়ী এ দিনটি শোক আর বেদনার মধ্যে আবদ্ধ নেই। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষের সর্বজনীন উৎসবের দিনও।
you ever been blogging for? you make blogging look easy.
The whole look of your website is magnificent, as well as the content
material!